Sunday, July 5, 2020

নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে আপনি কি কৌশল অবলম্বন করতে পারেন।


Cummings

বেশ কয়েক বছর আগে আমার আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ তলানিতে ঠেকেছিল। আমার স্বাভাবিক চরিত্র বরাবরই একটু ভিতু, নরম, বড্ড বেশী বাধ্য প্রকারের। ভয় লোক সমাজের, আত্মীয়- বন্ধুদের, ভয় ভালো মেয়ে থেকে খারাপ মেয়ে হয়ে যাওয়ার, ভয় হারিয়ে ফেলার, ভয় অপমানিত হওয়ার, ভয় হেরে যাওয়ার। অজস্র ধরনের ভয় নিয়ে আমি তৈরি হয়েছিলাম। কাউকে না করতে পারতাম না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই সব কাজ করতাম যাতে মন সায় দিত না। ভাবতাম এতে যাদের জন্য করছি তাঁরা খুশি হবেন বা সন্তুষ্ট হবেন। নিজে কষ্ট পেতাম কিন্তু সেটাকে বিবেচনায় আনাটা প্রয়োজন বোধ করতাম না। নিজের ভাললাগাগুলো ভুলতে লাগলাম। তারাও আস্তে আস্তে আমার থেকে দূরে সরে গেল। তাকিয়ে দেখার সুযোগই ছিল না তখন। শুধু অন্যকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত দিনরাত। নিজস্বতা হারিয়ে গেল। বাইরের জগতে কি ঘটছে জানার চেষ্টাই ছিল না। আমি চার দেওয়ালে নিজেকে বন্দী করে অন্যের স্বপ্ন সাজাতে মগ্ন। আমার স্বপ্নগুলো ভেসে গেল। আত্মবিশ্বাস বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব রইল না। যন্ত্রবৎ চলমান অশরীরী যেন। হঠাৎ একদিন জোর এক ধাক্কা এলো। তাকিয়ে দেখলাম যাদের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলাম তাঁরা পিঠে ছুরি মেরে পালিয়ে গেছে। কেউ নেই। আমি একা, নিঃস্ব, দৈন, রিক্ত। পড়ে পড়ে কাঁদলাম। খুব কাঁদলাম। চিৎকার করে ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানালাম। হাহাকার করে জানতে চাইলাম আমার অন্যায় কোথায়? কেন এরকম হল? আমার সথেই কেন? কি ক্ষতি করেছি আমি? কার ক্ষতি করেছি? কিন্তু তিনি বোবা কালা অন্ধ হয়ে রইলেন। কিছুদিন পর অনেক বছরের জমা ব্যাথা কমল। এবার ভাবতে শুরু করলাম। বুঝলাম যা করেছি ভুল। আমার অনেক জীবন দর্শনই আজকের যুগে অচল। কেঁদে লাভ নেই। কেউ তোমার জন্য তোমার বিপদে থাকে না। নিজের কথা নিজেকে ভাবতে হয়। সেদিন থেকে নতুন লড়াই শুরু। বেঁচে থাকার লড়াই। এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। নিজেকে মানুষ বলে ভাবতে শেখার লড়াই। নতুন করে নিজের আত্মবিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।নিজেকে বললাম - 'হয়েছে ! অনেক ন্যাকামো করেছো! নিজের দোষে নিজে ভুগছো। আরও ন্যাকামো মেরে কিস্যু লাভ হবে না। কিছু করার থাকলে করে দেখাও।' তো সেদিন থেকে কতগুলো পন্থা অবলম্বন করলাম। আজও সেগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আত্মবিশ্বাসে টই-টম্বুর নই ঠিকই। কিন্তু নিঃশ্বেষিত নই।


  • নিজেকে প্রস্তুত করাঃ যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে উপস্থাপন করার আগে নিজেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত করতে হবে। নিজেকে একটু সুন্দর দেখানো, একটু দিন দুনিয়ার খবর রাখা,চাঁদে কি হচ্ছে না জানলেও চলবে কিন্তু পাশের রাজ্যে কি হচ্ছে তার খবর জানা। আর সব থেকে দরকারি নিজেকে মনে মনে বলা " তুমি সুন্দর, তুমি শ্রেষ্ঠ। তুমি পারবেই। "
  • সুন্দর সাজসজ্জাঃ নিজেকে একটু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখাটা দোষের নয় কখনই। এর মানে এই নয় যে দামী নামকরা জিনিসপত্রের দোকান বানিয়ে ফেলতে হবে নিজেকে। বা অতিরিক্ত বেমানান প্রসাধনে বিকট চেহারা করতে হবে। কিন্তু নিজের চেহারার সাথে মানানসই পোশাক-পরিচ্ছদ-প্রসাধন আত্মবিশ্বাস এক ধাপ বাড়িয়ে দেয়।
  • ইতিবাচক মনোভাবঃ ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। চিন্তাভাবনায় সব সময় ইতিবাচক দিক পরিষ্কার করে নির্ধারণ করতে হবে। ইতিবাচক হওয়ার মানে এটা অবশ্যই নয় যে সব সময় সব কিছু আমাদের ইচ্ছা বা চিন্তা অনুয়ায়ী হবে। কিন্তু মনের জোর বাড়বে।
  • নেতিবাচক দূরীকরণঃ চিন্তার জগতে নেতিবাচক চিন্তা কম করতে হবে। আমি কখনই বলব না যে একেবারে করা যাবে না। সেটা কখনই সম্ভব নয়। অবশ্যই নেতিবাচক চিন্তা আসবে, আসা উচিত ও । এর জন্যও অন্য প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু কমাতে হবে। যখনই এরকম হবে তখনই অন্য কাজে যা ভাল লাগে - নিজেকে ব্যস্ত করতে হবে।এর সাথে নেতিবাচক মনভাবাকারী মানুষদের সঙ্গ একেবারে পরিত্যাজ্য। অন্যের অনবরত নেতিবাচক চিন্তা আমাদের মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। মানসিকভাবে আমরাও দুর্বল হয়ে পড়ি।
  • নিজেকে জানাঃ একটা কথা আছে যুদ্ধের মাঠে যাওয়ার আগে শত্রুর সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানা উচিত। যখন আমরা আমাদের নেতিবাচক চিন্তাশক্তিতে পরাজিত করতে শিখে যাই তখন আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ওঠে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ( Over Confidence) আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথের মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রুতে পরিণত হয়ে যাই। এই সময় আত্ম বিশ্লেষণ করা দরকার । নিজের খামতি গুলোকে খুঁজে বার করে মানতে হবে যে কিছু ক্ষেত্রে আমি পিছিয়ে। পিছিয়ে পড়া বিষয়গুলোকে যদি শিখে নেওয়া যায় তাহলে উন্নতির রাস্তা পরিষ্কার। কিন্তু না পারলে তা নিয়ে হীনমন্যতার কারণ নেই। প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু খামতি থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক। সেগুলোকে সঙ্গী করে মেনে নিয়ে এগোতে শিখলে আত্মবিশ্বাস সঠিক মাত্রায় বজায় থাকে।
  • সহানুভূতিশীল হওয়াঃ অন্যের প্রতি, অন্যের অনুভূতির প্রতি, অন্যের পরিস্থিতির প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। খুব ছোট্ট একটা সাহায্য অনেকের জীবনে আশার আলো জ্বেলে দিতে পারে। একটি হাস্যোজ্জ্বল মুখ আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে ও বজায় রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু তাই বলে অপাত্রে দান করার দরকার নেই। বা নিজেকে বিলিয়ে দিতেও হবে না। সামঞ্জস্য রাখতে জানতে হবে।
  • আদর্শ নির্দিষ্টকরণঃ নিজের মনে কিছু আদর্শ তৈরি করতে হবে। কোনও পরিস্থিতিতে বা কারও জন্যই আদর্শ বিচ্যুত না হওয়াই উচিত। এতে নিজের কাছে ছোট হতে হবে না। আত্মবিশ্বাস হারাবে না।
  • সঠিক ভঙ্গিমাঃ দাঁড়ানো বা হাঁটার সময় শারীরিক ভঙ্গিমা সঠিক রাখা দরকার। মেরুদণ্ড ও কাঁধ সোজা, মাথা উঁচু, সোজা তাকানো — এই স্বাভাবিক ভঙ্গিমা বজায় রাখতে হবে।
  • লক্ষ্য স্থির রাখতে হবেঃ কিছু কিছু লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আগামী দিনে কি কি করতে হবে। শুধু লক্ষ্য স্থির করলেই হবে না, তা কি করে অর্জন করা যায় তার পথ পরিষ্কার করতে হবে এবং তাতে সফল হতে হবে। ছোট বা বড় যে কোনো লক্ষ্যেই সফল হওয়া আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে সাহায্যকারী।
  • অভ্যাস তৈরি করাঃ ছোট হলেও কিছু ভাল অভ্যাস তৈরি করতে হবে এবং বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। যেমন ধূম্রপান ত্যাগ করা। ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠা, ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস জল খাওয়া। এইধরনের ছোট ছোট অভ্যাস যা নিজে সহজেই করা যায়, তা এক মাস করলেই মানসিকতার পরিবর্তন অনুভব করা যায়। একটা ভাল লাগা তৈরি হয়। যা মনের জোর বাড়াতে সাহায্য করে।
  • হাসি ধরে রাখাঃ দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা, যন্ত্রণা, অন্যায়, অবিচার, রোগ, ভোগ জীবনের আরেক নাম। এই সব না থাকলে আমরা যে বেঁচে আছি তা বুঝতে পারব কি করে? কথায় আছে — "কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?" সুতরাং দুঃখ দুর্যোগ যাই হোক না কেন হাসি ভুলে গেলে চলবে না। হাসার কারণ খুঁজে না পেলে এমনিই হেসে নেওয়া ভাল। মন ভাল লাগবে। মন ভাল তো শরীর ভাল, শরীর ভাল তো মেজাজ ভাল, মেজাজ ভাল তো বাকি সব ভাল। এক্ষেত্রে কিছু বন্ধু থাকা দরকার। যারা পরিস্থিতিকে পাত্তা না দিয়ে জোর করে হাসাতে সক্ষম।
  • জ্ঞানার্জনঃ চেষ্টা থাকতে হবে যে কোনও বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করার। বিষয় সম্বন্ধীয় জ্ঞান আত্মবিশ্বাসকে জোড়াল করতে সাহায্য করে। কোনও বিষয়ে উপস্থাপনার আগে সেই বিষয়ে ভাল জ্ঞান থাকা দরকার। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস এব্যাপারে যথেষ্ট ফলপ্রসূ।
  • নিজেকে গুরুত্ব দেওয়াঃ নিজেকে ভালবাসতে হবে।নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। নিজেকে দাম দিতে হবে। এব্যাপারে যদিও আমি নিজে পিছিয়ে। তবুও বলব নিজেকে নিজে দাম দিতে না পারলে অন্যরাও দেবে না। অতিরিক্ত মূল্যবোধ যেমন ক্ষতিকর, তেমনি নিজেকে মূল্যহীন করে ফেলাটাও আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলতে পারে। নিজের ছোট ক্ষমতাতেও ভরসা রাখতে হবে। যখনই নিজের প্রতি বিশ্বাসের অভাব হবে তখনই নিজের গুনের কথা মনে করে নিজেকে সাহস জোগাতে হবে। তবেই আত্মবিশ্বাস বজায় থাকবে । নিজেকে সময় দিতে হবে। সারাদিনে অন্তত কিছুটা সময় শুধু নিজের জন্য থাক।
  • সমস্যা ও সমাধান জানাঃ সমস্যার সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। সেগুলির সঠিক বিশ্লেষণ করার জন্য প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে। সুবিধার জন্য লেখা অভ্যাস করতে হবে। এক এক করে সমাধান খুঁজে বের করে তা প্রয়োগ করতে হবে।

আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে হলে সঠিক আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে আত্মবল বৃদ্ধি করাই হল মূলমন্ত্র।

H.M Arif

No comments:

Post a Comment