দাম্পত্য জীবনের ভালবাসা এবং নবীর সুন্নত
বিয়ে পরবর্তী রোমান্স যেনো আমৃত্যু টিকে থাকে এজন্য নিম্নের সুন্নাতি বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করুন!
❒ সহধর্মিণীর হৃদয়ের ভাষা বুঝুন
___________
রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার আ'ইশাকে (রা.) বললেন, হে আ'ইশা! আমি অবশ্যই জানি কখন তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাক আর কখন অসন্তুষ্ট হও। আ'ইশা রাঃ জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনি কিভাবে জানেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, যখন তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাক, তখন তুমি এরূপ বল,‘মুহাম্মাদের রবের কসম, আর যখন তুমি অসন্তুষ্ট হও তখন বল, ‘ইবরাহীমের রবের কসম’! আ'ইশা (রা.) বললেন, জী হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আল্লাহর শপথ! (রাগের সময়) আমি কেবল আপনার নামটাই বাদ দেই। (বুখারী ৫৬৪৯)
❒ স্ত্রী দুঃখ পেলে সান্ত্বনা দেয়া
___________
আল্লাহর রাসুল ﷺ এর প্রিয় সহধর্মিণী সাফিয়াহ (রা.) ইসলাম গ্রহনের পুর্বে ইহূদী ছিলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ একবার হযরত সাফিয়াহর (রা.) গৃহে গিয়ে দেখলেন, তিনি কাঁদছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি বললেন–আ'ইশা এবং যায়নাব বলেছেন, আমরা রাসুলুল্লাহর স্ত্রী এবং গৌরবের দিক হতে একই রক্তধারার অধিকারিণী। সুতরাং আমরাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। একথা শুনে রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, তুমি কেন বললে না যে, 'আমি আল্লাহর নবী হযরত হারুণের বংশধর ও হযরত মুসার ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ আমার স্বামী । অতএব তোমরা কোন দিক হতে আমার চাইতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পার?' অতঃপর আল্লাহর রাসুল ﷺ তাঁর নিজ হাত দিয়ে সাফিয়াহর (রা.) চোখ মুছে দিলেন।
❒ স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শোয়া
___________
আল্লাহর রাসুল ﷺ প্রায়সময় উম্মুল মু'মিনীন খাদিজা (রা.) এর কোলে মাথা রাখতেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর আ'ইশা (রা.) এর উরুর উপর মাথা রেখে শুতেন। যখন আ'ইশা (রা.) ঋতুবর্তী অবস্থায় উপনীত হতেন, তখন তিনি ﷺ তাঁর উরুর উপর শুয়ে কোর'আন তিলাওয়াত করতেন। (বুখারী ২৯৭)
একজন পুরুষ তার বৈবাহিক জীবনে কতোবার এভাবে স্ত্রীর উরুতে মাথা রেখে শুয়েছেন??
একটাবার ভাবুন, মহিলাদের এই সেন্সেটিভ সময়ে আপনার একটু সুক্ষ্ম আহ্লাদ তার মনের দুঃখ নিমিষেই ভুলিয়ে দিতে পারে। একবার মাথা রেখে দেখুনই না স্ত্রী সব উজাড় করে দিয়ে দিবে ইনশাআল্লাহ।
❒ একে অপরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিন
___________
উম্মুল মু'মিনীন আ'ইশা (রা.) প্রায় সময় রাসুলুল্লাহর ﷺ মাথার চুল আচড়ে দিতেন। এমনকি তিনি রাসুলুল্লাহ ﷺ এর মাথা ধৌত করে দিতেন। (বুখারী ২০২৮)
স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছাকাছি আসার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, একে অপরের মাথায় সিম্পলি হাত বুলিয়ে দেয়া বা একে অপরের চুল আচড়ে দেয়ার মাধ্যমে যে ভালোবাসার আদান-প্রদান হবে তা অবিশ্বাস্য!
❒ একই পাত্র হতে খাওয়ার অভ্যেস শুরু করুন
___________
যখন উম্মুল মু'মিনীন আ'ইশা (রা.) গ্লাসে করে পানি খেতেন, আল্লাহর রাসুল ﷺ ঠিক প্রিয় সহধর্মিণীর ঠোট লাগা অংশে ঠোট লাগিয়ে পানি পান করতেন। যখন আ'ইশা (রা.) গোশত খেতেন, তখন আল্লাহর রাসুল ﷺ আ'ইশা হতে গোশতটা টান দিয়ে নিয়ে নিতেন এবং ঠিক আ'ইশা (রা.) যেদিকটায় ঠোট লাগিয়ে খেয়েছেন, একই স্থান থেকে তিনি ﷺ ও খাওয়া শুরু করতেন। (মুসলিম ৫৮৫)
❒ লজ্জা ফেলে মুসাহাফা করুন
___________
আল্লাহর রাসুল ﷺ প্রায় সময় স্ত্রীদের চুমু খেতেন। তাঁদের সাথে আদর আহ্লাদ করতেন। যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ সিয়াম রাখতেন, ঠিক তখন তিনি স্ত্রীদের চুমু দিয়েছেন এমন কথাও হাদিসে পাওয়া যায়। (বুখারী ৩২২)
স্ত্রীর চোখে চোখ রাখা, তার কাজের মধ্যখান দিয়ে হুট করে চুমু দিয়ে আসা, আপনার ভালোবাসার গভীরতাকে আপনার স্ত্রীর অন্তরে পৌছুতে সাহায্য করবে। ভালোবাসা লুকোনোর বিষয় নয়, তা প্রকাশ করার মাধ্যম ইসলাম শিখিয়েছে আমাদের। লজ্জা ভুলে একে অপরের সম্মুখে ভালোবাসা প্রকাশ করা শুরু করুন। একে অপরের সাথে মিলিত হন, কাছে টানুন। নিশ্চই স্বামী স্ত্রীর পবিত্র মিলন সাদাকাহ হিসেবে আল্লাহ তা'য়লা কবুল করেন।
❒ একে অপরের মুখে হাত তুলে খাইয়ে দিন
___________
আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেন- তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্যেশ্যে যা ব্যয় করবে তার উত্তম প্রতিদান পাবে, এমনকি স্বীয় স্ত্রীর মুখে তুলে দেওয়া লোকমার বিনিময়েও। (বুখারী ৫৬)
❒ স্ত্রীর হাতের কাজে সাহায্য করুন
___________
আসওয়াদ (রহ.) বলেন – আমি আ'ইশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ ﷺ ঘরে কী কাজ করতেন? তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতেন অর্থাৎ গৃহস্থালির কাজে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতায় থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো নামাজে চলে যেতেন। (বুখারী ৬৭৬)
❒ স্ত্রীর সাথে গল্প করতে ভুলবেন না
___________
আল্লাহর রাসুল ﷺ প্রায় সময় তাঁর স্ত্রীদের গল্প শোনাতেন। আ'ইশা (রা.) কে তিনি উম্মে যারাহ এর বিখ্যাত গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন যে, 'হে আ'ইশা আমি তোমাকে আবু যারাহ এর মতো ভালোবাসি, যেভাবে সে উম্মে যারাহ কে ভালোবাসতো'।
প্রতিদিন বাইরে যে কর্মব্যস্ত সময়ে কাটে তা প্রিয় সহধর্মিণীকে শেয়ার করতে পারেন, এতে আপনার উপর তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে জন্মাবে।
❒ স্ত্রীকে নিয়ে তার প্রিয় জায়গায় ঘুরতে যান
___________
একবার ইথিওপিয়া থেকে কিছু লোক এসে মাসজিদ আন নববীতে তরবারি খেলা দেখাচ্ছিল। আ'ইশা (রা.) রাসূল ﷺ কে বললেন তিনি খেলা দেখতে চান। এমন অবস্থায় আমরা হলে কী বলতাম? “হ্যাঁ! উম্মাহর এই অবস্থা আর তুমি চাও খেলা দেখতে!! ছি! যাও যাও কুরআন পড়”
অথচ রাসূল ﷺ আ'ইশাকে নিয়ে গেলেন এবং তাঁকে আড়াল করে সামনে দাঁড়িয়ে । আ'ইশা (রা.) রাসূলুল্লাহর পিছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে লাগলেন। এত দীর্ঘ সময় তিনি খেলা দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বারবার এক পা থেকে আরেক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। তিনি আ'ইশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন যে তাঁর দেখা শেষ হয়েছে কিনা। আ'ইশা বললেন তিনি আরো দেখতে চান। কোন আপত্তি না করে রাসূল ﷺ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। দীর্ঘক্ষণ পর আ'ইশা (রা.) নিজেই ক্লান্ত হয়ে বললেন যথেষ্ট হয়েছে। এরপর রাসূল ﷺ তাঁকে বাসায় নিয়ে আসলেন। (বুখারী ৪৫৪)
❒ স্ত্রীর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করুন
___________
আ'ইশা (রা.) তখন হালকা গড়নের ছিলেন। রাসূল ﷺ কোন এক সফর থেকে ফিরছিলেন, সাথে ছিলেন আ'ইশা। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন সামনে এগিয়ে যেতে। তাঁরা চোখের আড়াল হলে রাসূল ﷺ আ'ইশাকে দৌড় প্রতিযোগীতায় আহ্বান করলেন। আয়েশা জিতে গেলেন সেইবার। কয়েকবছর পর একই সিনারিও। আবার রাসূল ﷺ আ'ইশাকে (রা.) দৌড় প্রতিযোগীতায় আহ্বান করলেন। এবার রাসূল ﷺ জিতে গিয়ে মজা করে বললেন, “এটা আগেরটার শোধ।” (আবু দাউদ ২৫৭৮)
আমাদের দেশের পুরুষরা কি স্ত্রীর সাথে এমন প্রতিযোগিতা করেছে কখনো? আপনি শুরু করুন।
❒ সহধর্মিণীকে প্রিয় নামে ডাকুন
___________
আ'ইশাকে (রা.) নবী ﷺ আদর করে ডাকতেন হুমায়রা বলে। হুমায়রা অর্থ 'লাল বর্ণের রমনী'। রাসুলুল্লাহ ﷺ এর আদর মাখা ডাক শুনে আ'ইশা (রা.) কাছে আসতেন তাকে জড়িয়ে ধরতেন, এরপর কবিতা পাঠ করে আল্লাহর রাসুলকে ﷺ শোনাতেন। (ইবনে মাজাহ ২৪৭৪)
এমনও হয়েছে আল্লাহর রাসুল ﷺ একবার আ'ইশার (রা.) দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলেন – "তোমার চক্ষুদ্বয় কত্ত সাদা.."
প্রিয় সহধর্মিণীকে এমন ভালো অর্থবোধক নামে ডাকতে পারেন, এতে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। একে অপরকে যতো বেশী কম্পলিমেন্ট দেয়া যায়, ঠিক ততো একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখতে সুবিধে হবে।
❒ প্রিয় মানুষের জন্য নিজেকে সাজান
___________
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন – "আমি যেমন আমার জন্য স্ত্রীর সাজগোজ কামনা করি, অনুরূপ তার জন্য আমার নিজের সাজগোজও পছন্দ করি।" অর্থাৎ যাবতীয় সাজসজ্জা যেনো কেবল প্রিয় মানুষকে খুশি করার জন্যই করা হয়, এতে পস্পরের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে এবং একে অপরকে আরো অধিকভাবে কাছে টানতে পারবে।
আমাদের দেশের নারীরা তো এক্ষেত্রে বলা চলে স্বামীর সামনে ছেঁড়া পুরোনো কাপড়ই পরিধান করে!
অথচ এক্ষেত্রে উচিত সবচেয়ে বেস্ট পোশাক একে অপরের জন্য পরিধান করা।
❒ সুগন্ধী ব্যবহার করা
___________
আ'ইশা (রা.) এর কাছে যেসব সুগন্ধি থাকত, সেগুলো থেকে উত্তম সুগন্ধি হজরত আ'ইশা (রা.) রাসুলুল্লাহ ﷺ কে লাগিয়ে দিতেন; সুগন্ধী আল্লাহর রাসুল ﷺ এর প্রিয় ছিলো। (বুখারী ২৬৭)
স্বামীদের উচিত তাদের স্ত্রীদের সম্মুখে সুগন্ধী ব্যবহার করা, এবং স্ত্রীদের উচিত তাদের স্বামীদের সম্মুখে নিজেকে রঙ দিয়ে সাজানো যা তাকে আকৃষ্ট করে।
❒ বৈবাহিক সম্পর্কের গোপনীয়তা রক্ষা করা
___________
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে উপভোগ্য বিষয়গুলো গোপন করা এবং সাংসারিক সমস্যা নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা না করাই শ্রেয়।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, 'কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সর্ব-নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে, যে নিজের স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং যার সাথে তার স্ত্রী মিলিত হয়, অতঃপর সে এর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়'। (মুসলিম ১৪৩৭)
তাই এব্যাপারে খুব সতর্ক হতে হবে, ভুলেও যেনো একে অপরের গোপনীয় কথা অন্যকে না বলা হয়; আমাদের সমাজে অধিকাংশ বিয়ে ভেঙ্গে যায় কেবল এই বিষয়ে অবহেলার কারনে!
❒ স্ত্রীর পরিবার এবং আত্মীয়ের খবর নেয়া
___________
নবীজি ﷺ মাঝে মাঝে একটা ভেড়া জবাই করে বলতেন "এই ভেড়ার মাংস খাদিজার বান্ধবীদের জন্য পাঠিয়ে দাও।" লক্ষ করুন, নবীজি যে কেবল খাদিজার জীবিত অবস্থায় এমন করেছেন তা নয় বরং তিনি তো খাদিজা (রা.) মারা যাবার পরেও তাঁর বান্ধবীদের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রেখেছেন। এটা তিনি করতেন খাদিজার প্রতি ভালোবাসা থেকে।
আবু বকর (রা.) একবার বলছিলেন, আমি তিনটি বিষয় খুব পছন্দ করি, এর মাঝে একটি হল -'আমি মুহাম্মদের শ্বশুর' উক্ত কথা দ্বারা এটাই প্রমান করে আল্লাহর রাসুল ﷺ শ্বশুর বাড়ির লোকেদের কেমন মহব্বত করতেন এবং কতোটা আপন করে নিয়েছিলেন।
তাই স্বামীদের উচিত স্ত্রী পক্ষের আত্মীয়ের এবং পরিবারের দেখাশোনা করা এবং স্ত্রীর উচিত স্বামীর পরিবারের এবং আত্মীয়ের দেখভাল করা। তবেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাবে এবং ভালোবাসা অটুট থাকবে।
কি শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাই না ছিলো আল্লাহর রাসুল ﷺ এবং তাঁর সহধর্মিণীদের মাঝে! আপনিও একই সুন্নাহ অনুসরন করুন।
রাসুল ﷺ কে ভালোবেসে আপনি যদি একইভাবে আপনার স্ত্রীকেও ভালোবাসতে থাকেন, এরচেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না।
▂▂▂▂▂▂▂▂▂ ▂▂▂▂
No comments:
Post a Comment